অপারেটিং সিস্টেম: আপনার কম্পিউটারের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক

অপারেটিং সিস্টেম: আপনার কম্পিউটারের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক

আমরা প্রতিদিন কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন ব্যবহার করি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন—এই যন্ত্রগুলো এত নিখুঁতভাবে আপনার দেওয়া কাজগুলো করে ফেলছে কীভাবে? আপনি একটা অ্যাপ খুললেন, কোনো কিছু টাইপ করলেন, আপনার ডিভাইসের মিউজিক প্লেয়ার খুলে গান শুনা শুরু করলেন বা আপনার আবসার কাটাতে কোনো একটি গেম খেলা শুরু করলেন — এই যে এত কিছু আপনার চাহিদা অনুযায়ী মসৃণভাবে কাজ করা শুরু করল। আসলেই কি এত কিছু এমনি এমনি আপনার কেনা জাস্ট কিছু যন্ত্র নিজে নিজে করতে শুরু করেছে? না!!!

এই “মসৃণতা”র পেছনে রয়েছে এক অদৃশ্য পরিচালক, যাকে আমরা —অপারেটিং সিস্টেম (Operating System), সংক্ষেপে OS হিসাবে চিনি।


চলুন জেনে নিই অপারেটিং সিস্টেম আসলে কী?

অপারেটিং সিস্টেম হলো একটি বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার, যা আপনার কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারকে একসাথে কাজ করতে সাহায্য করে। যদি আমরা কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারকে মানবদেহের সাথে তুলনা করি তবে অপারেটিং সিস্টেম হলো কম্পিউটারের নিউরোসিস্টেম (স্নায়ুতন্ত্র)। এটি হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের মধ্যে যোগাযোগ করে কম্পিউটারের সমস্ত কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।

আরও সহজভাবে বললে, এটি এমন একটি মাধ্যম যার সাহায্যে আপনি আপনার কম্পিউটারের যন্ত্রগুলোর সথে কথা বলতে পারেন, আর যন্ত্রগুলো আপনার কথা বুঝে আপনার দেওয়া কাজটি সম্পন্ন করতে পারে।
যেমন:

  • আপনি কিছু টাইপ করলে OS সেই লেখাকে আপনার স্ক্রিনে দেখায়।
  • আপনি মাউস নাড়ালে OS তা বুঝে নির্দেশ দেয় কোন অ্যাপ খুলতে হবে।
  • আপনি গান চালালে OS ঠিক করে দেয় কোন স্পিকারে সেই শব্দ যাবে। ইত্যাদি

যদি অপারেটিং সিস্টেম না থাকতো তবে কী হতো?

কম্পিউটার চালু করলেও কিছুই হতো না! OS ছাড়া কম্পিউটারে আপনার কোনো কথা বুঝতে পারে না। OS ছাড়া কম্পিউটার জানেনা আপনি কি চান। কীভাবে কীবোর্ড, মাউস, স্ক্রিন, মেমোরি, কিংবা ফাইল সিস্টেমের সাথে কাজ করতে হয়।

একটি OS ছাড়া কম্পিউটার অনেকটা একটা গাড়ির মতো—যেখানে ইঞ্জিন আছে, চাকা আছে, কিন্তু চালানোর জন্য কোনো চালক নেই।


অপারেটিং সিস্টেম আসলে কী কাজ করে?

OS কম্পিউটারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। নিচে কাজগুলো সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করছি:

১. প্রসেস ম্যানেজমেন্ট (Process Management)

একটি অ্যাপ বা প্রোগ্রাম যখন চালু হয়, তখন সেটি “প্রসেস”-এ রূপান্তরিত হয়। OS এই প্রসেস তৈরি করে, চালায়, স্থগিত করে এবং প্রসেস শেষে বন্ধও করে। অনেক প্রসেস একসাথে চললেও, বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন কন্টেক্স সুইচিং এর মাধ্যমে OS নিশ্চিত করে তারা একে অপরের সাথে কনফ্লিক্ট বা সংঘর্ষে না জড়ায়।

:pushpin: উদাহরণ হিসেবে, আপনি একই সময়ে মিউজিক শুনছেন এবং সেই সময় ওয়ার্ডে লিখছেন — OS নিশ্চিত করে কোনো ধরনের কনফ্লিক্ট ছাড়া দুইটি প্রসেসই ঠিকঠাক চলছে।


২. মেমোরি ম্যানেজমেন্ট (Memory Management)

আমাদের কম্পিউটারে RAM এর কিন্তু লিমিটেশন রয়েছে। অনেক অ্যাপ একসাথে চললে অনেক সময় দেখা যায় RAM ফুল হয়ে কিছু অ্যাপ ক্রাশ করে। OS এই বিষয়গুলোও নিয়ন্ত্রণ করে। কখন কোন অ্যাপটি কতটুকু মেমোরি ব্যবহার করবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যবহার শেষ হলে সেই মেমোরি খালি করে দেয়।

:pushpin: উদাহরণ হিসাবে, অনেক অ্যাপ একসাথে চালালে দেখা যায় পুরনো কিছু অ্যাপ বন্ধ হয়ে যায় — OS এই কাজগুলো করে থাকে।


৩. ফাইল ম্যানেজমেন্ট (File Management)

HDD, SSD, Pendrive ইত্যাদি সেকেন্ডারি storage সিস্টেমে কোনো ডাটা ষ্টোর করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল অপারেশন OS করে তাকে। আপনি যখন কোনো ফাইল তৈরি করেন, সেভ করেন বা ওপেন করেন, তখন সবকিছু OS নিয়ন্ত্রণ করে।

ফাইল কোথায় থাকবে, কে খুলতে পারবে, কত জায়গা নেবে — সব OS-এর হাতে।


৪. ইনপুট/আউটপুট কন্ট্রোল (I/O Management)

যদি আপনার কাছে শুধু মাত্র একটি CPU থাকে আপনি চাইলেই তাকে দিয়ে কোনো কাজ করিয়ে নিতে পারবেন নাহ, OS এর সাথে কথা বলার জন্য আমরা কিছু পেরিফেরাল ডিভাইস ব্যবহার করি। যেমন কীবোর্ড, মাউস, টাচস্ক্রিন, প্রিন্টার, স্পিকার ইত্যাদি। এই পেরিফেরাল ডিভাইস গুলো কি ধরনের একশানের বিপরীতে আপনার কম্পিউটার কিভাবে ইন্টারাক্ট করবে সেটিও OS নির্ধারন করে।

:pushpin: উদাহরণ: আপনি কিছু টাইপ করলেন — OS কীবোর্ড থেকে ইনপুট নিলো, তারপর স্ক্রিনে সেটির আউটপুট দেখালো।


৫. ইউজার ইন্টারফেস (User Interface)

OS আপনাকে কম্পিউটারের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করার মধ্যম দেয়। আপনার মেশিন 0 এবং 1 অর্থাৎ বাইনারি ছাড়া কিছুই বোঝে নাহ। আবার আমার বাইনারি বুঝি নাহ,এরই সমাধানের জন্য OS আপনাকে একটি বোধগম্য intaface প্রদান করে যা দিয়ে আপনি দেখে, বুঝে আপনার কাঙ্ক্ষিত কাজটি করে নিতে পারেন।
এটি হতে পারে:

  • গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস (যেমন Windows, Android, macOS)
  • কমান্ড লাইন ইন্টারফেস (যেমন Linux-এর টার্মিনাল)

:pushpin: উদাহরণ: আপনি ফোল্ডারে ডাবল ক্লিক করে ফাইল খুলেছেন, কোনো ভিডিও প্রোগ্রেস বার টেনে যে কোনো জায়গা থেকে দেখতে পারেন ইত্যাদি।


৬. নিরাপত্তা ও অ্যাক্সেস কন্ট্রোল (Security & Access Control)

আপনার ডিভাইসের ব্যক্তিগত কিংবা ব্যবসায়িক যে কোনো ফাইলের নিরাপত্তা OS নিশ্চিত করে। যেন যে কেও চাইলেয় আপনার ফাইল বা তথ্য কেউ চুরি করতে না পারে।

যেমন, পাসওয়ার্ড, ইউজার প্রোফাইল, পারমিশন ইত্যাদি সব OS এর মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হয়।


৭. ডিভাইস ড্রাইভার ম্যানেজমেন্ট

প্রতিটি হার্ডওয়্যার (মাউস, কীবোর্ড, প্রিন্টার) কাজ করতে হলে তাকে OS চিনতে হয়।
OS এসব যন্ত্রকে চিনে এবং চালাতে “ড্রাইভার” ব্যবহার করে। যেখানে হার্ডওয়্যার এর যাবতীয় ইনফরমেশন দেওয়া থাকে।

:pushpin: উদাহরণ: আপনি নতুন প্রিন্টার লাগালে সেটিকে কার্যক্ষম করতে ড্রাইভার সেটআপ করতে হয়।


জনপ্রিয় OS-গুলো হলোঃ

নাম ব্যবহারের জায়গা
Windows ডেস্কটপ ও ল্যাপটপে
macOS Apple কম্পিউটারে
Linux সার্ভার ও প্রফেশনাল কাজে
Android স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটে
iOS iPhone ও iPad-এ

এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন কেন OS এত গুরুত্বপূর্ণ?

আপনার ডিভাইসের প্রতিটি ক্লিক, টাইপ, বা অ্যাপ চালানো থেকে শুরু করে সকল কাজের পেছনে OS কাজ করে যাচ্ছে। এটি না থাকলে কোনো অ্যাপ চলত না, কোনো ফাইল খোলা যেত না, এমনকি স্ক্রিনে কিছুই দেখা যেত না। এটি আপনার ডিভাইসের মস্তিষ্কের মতো কাজ করে — সবকিছু নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করে।


শেষ কথা

অপারেটিং সিস্টেম এমন এক সফটওয়্যার, যেটা আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের ডিভাইসের ভিতরে কাজ করে যাচ্ছে নিবৃতে। এটি ছাড়া প্রযুক্তি জগত অচল প্রায়।

তাই, পরের বার আপনি যখন ফোনে ভিডিও দেখবেন, কম্পিউটারে কোড লিখবেন, কিংবা কোনো ছবি এডিট করবেন — একটু থেমে ভাবুন, এই অসাধারণ সফটওয়্যারটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে আপনের প্রতিদিনের জীবনে!

আলহামদুলিল্লাহ, এই লেখার মাধ্যমে কম্পিউটার আর্কিটেকচার এর ধারাবাহিক পোষ্টের সূচনা হলো, ইনশাআল্লাহ পর্যায়ক্রমে আমরা প্রত্যেকটি টপিক কভার করার চেষ্টা করব।

অপারেটিং সিস্টেম — আপনার ডিভাইসের অদৃশ্য কিন্তু অপরিহার্য বন্ধু।
২৩/০৫/২০২৫