ব্রায়ান ট্রেসি একজন জনপ্রিয় কানাডীয়-আমেরিকান লেখক এবং আত্মোন্নয়নমূলক বক্তা। তাঁর লেখা ‘ইট দ্যাট ফ্রগ’ বইটি ২০০১ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ৪২টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বইটিতে তিনি সহজ ও কার্যকর উপায়ে সময় ব্যবস্থাপনা ও কাজের দক্ষতা বাড়ানোর নানা টিপস দিয়েছেন, যা অনেকের জীবনকে আরও সফল ও সংগঠিত করেছে। এই বই থেকে আমি যেসব দারুণ শিক্ষা পেয়েছি:
কঠিন কাজের সাথে প্রথমে মোকাবিলা করুন:
ব্রায়ান ট্রেসি তাঁর বইয়ে প্রতিদিনের কঠিন কাজগুলোকে প্রতীকীভাবে ‘ব্যাঙ খাওয়ার’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই ব্যাঙ হলো এমন কাজ, যা হয়তো আপনার করতে একদম ভালো লাগে না বা কঠিন মনে হয়, কিন্তু সেটি খুবই জরুরি। এই ধরনের কাজগুলো দিনের শুরুতেই করতে হবে। কারণ দিনের শুরুতে আপনার শক্তি ও মনোযোগ সর্বোচ্চ থাকে। কঠিন কাজগুলো আগে শেষ করলে পরবর্তী সহজ বা কম গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে আপনি সহজে এবং কম মানসিক চাপ নিয়ে করতে পারবেন। লেখকের মতে, যারা গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো এড়িয়ে রাখে বা দেরি করে, তারা ভবিষ্যতে আরো বেশি চাপ এবং অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়। তাই সময় নষ্ট না করে, দিনের শুরুতেই সেই সব কাজ হাতে নেওয়া উচিত যা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।
লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেই অনুযায়ী এগিয়ে চলা:
সফল হতে চাইলে একটি পরিষ্কার ও সুসংহত লক্ষ্য নির্ধারণ করা অপরিহার্য। ব্রায়ান ট্রেসি লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এবং বাস্তবমুখী ধারণা তৈরির উপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, লক্ষ্যটি কেবল মাথায় না রেখে, তা লিখে ফেলুন। এটি আপনাকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেবে আপনার অর্জন করার পথ। লেখক পরামর্শ দেন, শুধু লক্ষ্য নির্ধারণ করলেই হবে না, সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য কার্যকরী একটি কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে হবে। সেই কর্মপদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। লক্ষ্য নির্ধারণের ফলে কাজগুলোতে স্পষ্টতা আসবে, এবং কীভাবে, কতটুকু সময়ে, এবং কোন পদ্ধতিতে তা পূরণ করতে হবে, তা সহজেই নির্ধারণ করা যাবে।
কাজের শ্রেণিবিভাগ এবং অগ্রাধিকার:
ব্রায়ান ট্রেসি কাজের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণে অত্যন্ত বাস্তববাদী পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেন, সব কাজ একসঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই কাজগুলোকে আলাদা শ্রেণিতে ভাগ করা জরুরি। তাঁর ‘এ, বি, সি, ডি’ শ্রেণিবিভাগ পদ্ধতি অনুযায়ী, “এ” শ্রেণিতে রাখুন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ফলপ্রসূ কাজগুলো, যা আপনার লক্ষ্য পূরণে সরাসরি অবদান রাখে। এরপর “বি” শ্রেণিতে রাখুন মাঝারি গুরুত্বের কাজ, “সি” শ্রেণিতে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং “ডি” শ্রেণিতে এমন কাজগুলো, যা না করলেও চলবে বা অন্য কাউকে দিয়ে করানো যায়। এই পদ্ধতিতে কাজগুলোকে ধাপে ধাপে সম্পন্ন করলে আপনি নিজে আরও বেশি সংগঠিত ও কার্যকরভাবে সময় ব্যয় করতে পারবেন, এবং চাপ কম অনুভব করবেন।
আগের রাতে পরিকল্পনা করে রাখুন:
লেখক প্রতিদিনের কাজের পরিকল্পনা আগের রাতেই করে রাখার উপদেশ দিয়েছেন। এতে আপনি পরের দিন কোন কাজটি আগে করবেন, তা আগে থেকেই জানবেন এবং প্রস্তুত থাকবেন। সকালে উঠে ভাবতে হবে না কোন কাজটা আগে শুরু করবেন। এমনকি ট্রেসি মনে করেন, রাতের আগাম পরিকল্পনার মাধ্যমে পরদিন আপনি আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে দিন শুরু করবেন। এতে করে দিনের মূল্যবান সময় অপচয় হবে না এবং কর্মক্ষমতা বাড়বে। আপনার পরিকল্পনার মধ্যে প্রধান কাজগুলো থাকলে তা নিশ্চিত করবে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ পড়বে না এবং আপনাকে নিজের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করবে না।
কাজে নামুন, দেরি করবেন না:
কেবল স্বপ্ন দেখলেই সফলতা আসবে না। পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করতে দেরি করলে, তা পরে আরো কঠিন হয়ে ওঠে। ব্রায়ান ট্রেসি এই দেরি করাকে বা গড়িমসিকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কাজ না করে শুধু পরিকল্পনা করলে সেটি ভয় এবং সংশয়ের সৃষ্টি করতে পারে। এই ভয় আপনার আত্মবিশ্বাসকে নষ্ট করে এবং কাজ শুরু করতে ভয় পাওয়াতে আপনি বারবার পেছাতে থাকেন। তাই কাজ যত কঠিনই হোক না কেন, দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে। যখনই আপনি কাজ শুরু করবেন, তখন আপনার অনিশ্চয়তা দূর হবে এবং কাজের অগ্রগতি সহজতর হবে। সফলতার প্রথম ধাপই হলো কাজে হাত দেওয়া।
আত্মশৃঙ্খলা এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখুন:
কোনো কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হল আত্মশৃঙ্খলা। ট্রেসি সময় ব্যবস্থাপনা এবং কাজের শৃঙ্খলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মনে করেন, যত কঠিন বা বিরক্তিকর কাজই হোক না কেন, আপনি যদি শৃঙ্খলা বজায় রেখে তা সম্পন্ন করতে পারেন, তবে তা আপনার সফলতার পথ খুলে দেবে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে এবং নিজের ইচ্ছাশক্তিকে মজবুত করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী সফলতা পেতে হলে দৈনন্দিন জীবনে শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলাই একমাত্র উপায়।
বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকুন:
আজকের যুগে, কাজের সময়ে বিভ্রান্তি একটি বড় শত্রু। মোবাইল ফোন, সামাজিক মাধ্যম এবং অন্যান্য প্রযুক্তি সহজেই মনোযোগ নষ্ট করতে পারে। লেখক বলছেন, কাজ করার সময় এই ধরনের বিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন বা পড়াশোনায় মনোনিবেশ করছেন, তখন আপনার মোবাইল ফোন বা অন্যান্য মনোযোগবিভাজক যন্ত্রপাতি দূরে রাখুন। কাজের প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ দিলে কাজ দ্রুত এবং সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। একবার মনোযোগ হারালে পুনরায় তা অর্জন করতে সময় বেশি লাগে।
প্রযুক্তি ব্যবহার করুন তবে সীমিতভাবে:
প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে, তবে প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়াও ক্ষতিকর হতে পারে। লেখক প্রস্তাব দেন, কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্ন টুলস বা অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে, যা আপনাকে সাহায্য করবে, কিন্তু তা আপনার মনোযোগকে বিঘ্নিত করবে না। উদাহরণস্বরূপ, কাজের সময় টাইমার বা নোটস অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু সামাজিক মাধ্যম বা গেমিং অ্যাপ থেকে দূরে থাকা জরুরি। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কাজের গতি বাড়ানো সম্ভব, তবে এর উপর নির্ভর না করে স্ব-উন্নতির দিকে নজর দিতে হবে।
নিজের উন্নতির পর্যালোচনা করুন:
লেখকের মতে, শুধু কাজ করলেই হবে না, প্রতিনিয়ত নিজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা জরুরি। আপনি যা করছেন, তা কতটুকু ফলপ্রসূ হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি কোন কাজের ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখা না যায়, তবে কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। কখনও কখনও কৌশলগত পরিবর্তন আপনার কাজকে আরও সহজ এবং দ্রুততর করতে পারে। শুধুমাত্র কঠোর পরিশ্রমের পরিবর্তে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করলে সফলতা পাওয়া যায়।